কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ কুড়িগ্রামের উলিপুরে ম্বাধীনতার ৫৫ বছর পরেও ‘৭১ এর বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর দিন কাটে ভিক্ষা করে। আওয়ামী দূঃশাসনের কারনেই ভারতীয় তালিকার ৩৯৭০৩ নম্বরের মৃত: ঐ মুক্তিযোদ্ধার একমাত্র ছেলে ঠেলাগাড়ী চালক নিরক্ষর আঃ জব্বার ভিক্ষুক মা জোবেদার জন্য মুক্তিযোদ্ধার ভাতা চালু করতে পারেনি কোন ভাবেই।
অন্যদিকে, একই নামধারী সরকারি এক চাকুরিজীবির বিরুদ্ধে মৃত: মুক্তিযোদ্ধার ভারতীয় তালিকার নম্বর ব্যবহার করে ভাতা ভোগের অভিযোগ। একাধিকবার দাবি নিয়ে প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারে দ্বারে হন্যে হয়ে ঘুরলেও পাত্তা দেয়নি কেউ মৃত: ঐ মুক্তিযোদ্ধার ছেলে আ: জব্বারকে।
২০২৪ এর ৫ আগষ্টের পট পরিবর্তনের পর মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা বাতিলের উদ্যোগ নেয়ায়, অতি সম্প্রতি জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছে মৃত: ঐ মুক্তিযোদ্ধার একমাত্র ছেলে নিরক্ষর ঠেলাগাড়ী চালক আঃ জব্বার।
ইতোপূর্বে ভাতাভোগীর ঐ ভাতা বাতিল করে জব্বারের মায়ের নামে ভাতা চালু করে দিতে জব্বারের কাছে ২ লাখ টাকা খরচ হবে বলে দাবি করেছিল জনৈক্য এক মুক্তিযোদ্ধা। করনার সময় ভিক্ষুক মায়ের ফিতরা আদায় ও ভিক্ষামিলে জমিয়ে একত্রে ৮ হাজার টাকাও দিয়েছিল জব্বার। চুক্তি হয়েছিল, কাজ করে দিলে আরো ৪০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে দিবে সে। কাজ হবে বলে আশাও দিয়েছিল কিন্তু সেই আশার মূখেও ছাই পড়েছে। জব্বারের অভিযোগ, চাহিদামত টাকার যোগান দিতে না পারায় আমার বাবার নামের ভাতা মা জোবেদার নামে চালু করে দেয়নি। মুক্তিযোদ্ধার নিকট দেয়া ৮ হাজার টাকা ফেরতের জন্য বহুবার চেষ্টা করে আজও টাকা ফেরত পায়নি সে।
জব্বার জানায়, ঠেলাগাড়ি চালিয়ে আমার সন্তানদের নিয়ে দিন কাটে খেয়ে না খেয়ে, তাই মা আমার আজও বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা করে জীবন বাঁচায়।
জব্বার আরো জানায়, বাবার সহযোদ্ধাসহ অনেকের মূখে শুনেছি, বাবার নামের সাথে মিল থাকায় অন্য ইউনিয়নের এক সরকারি চাকুরিজীবি অনেক টাকা খরচ করে ভাতা চালু করে নিয়েছে। ২০২৩ সালের জুনে জেলা প্রশাসকের স্বরনাপন্ন হয়ে ভাতার জন্য আবেদন করে আবারো আশার আলো দেখেছিল জব্বার কিন্তু সেই আবেদন তৎকালীন জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য পাঠালেও উপজেলা সমাজ সেবা দপ্তর ওই আদেশ আমলে নিলেও প্রতারিত করেছে জব্বারকে। কারণ ভারতীয় তালিকায় স্পষ্ট উল্লেখ করা হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামের মফিজুল ইসলামের ক্রমিক নং-৩৯৭০৩ নম্বরটি ব্যবহার করেই ভাতা ভোগ করছেন, দলদলিয়া ইউনিয়নের আর এক মফিজুল ইসলাম। তিনি বর্তমানে অবসরে যাওয়া একজন উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা। উপজেলার উত্তর দলদলিয়া ইউনিয়নের কুটিপাড়া গ্রামে তার বাড়ি। কথা হয় ভাতাভোগী মফিজুল ইসলামের সাথে।
তিনি সাক্ষাতকারে জানান, আমি ২০১০ সাল থেকে ভাতা ভোগ করে আসছি । ২০২৩ সালে মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর দাবিদার জোবেদা বেগম নামের একজন আমাকে ভূয়া প্রমাণ করতে আবেদন করেছিল কিন্তু সমাজ সেবা কর্মকর্তার তদন্তে উত্তর দলদলিয়া এলাকায় তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই আমি সঠিক মুক্তিযোদ্ধা বলে সমাজসেবা কর্মকর্তা প্রতিবেদন দিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা চালু হওয়ার পূর্ব সময় পর্যন্ত মৃত: মফিজুল ইসলামের একমাত্র ছেলে ঠেলাগাড়ী চালক আঃ জব্বার কখনোই ভাবেনি যে, মুক্তিযোদ্ধারা একসময় ভাতা পাবেন কিংবা তার বাবার এত মূল্যায়ন করবে সরকার। তাই নিজের জীবন সংগ্রাম করতেই বাবা যে বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিল, তার খোঁজও করেননি কোনদিন। প্রয়োজন মনে করেনি বাবার মুক্তিযোদ্ধার সনদ সংগ্রহ করে রাখার। ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘ প্রায় ৪০/৪৫ বছর ধরে ভারতীয় তালিকার ৩৯৭০৩ নম্বরের মুক্তিযোদ্ধার দাবিদার হিসেবে কেউ ছিল না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মুক্তিযোদ্ধা বলেছেন, একই নাম ও বাবার নাম বনে যাওয়ায় এবং দীর্ঘ সময় মুক্তিযোদ্ধার দাবিদার কেউ না থাকার সুযোগ নিয়েছে ঐ ভাতা ভোগী উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা। তারা আরো জানায়, ভারতীয় তালিকার ঠিকানা অনুযায়ী অনন্তপুর হাতিয়া ইউনিয়নের মফিজুল ইসলাম কিংবা তার পরিবারের লোকজনই মুক্তিযোদ্ধার দাবিদার হবে। অন্য ইউনিয়নের কেউ ভারতীয় তালিকার ওই নম্বর ব্যাবহার করার কোন এখতিয়ার নেই। দাবি করতে পারে সংশ্লিষ্ট এলাকার যে কোন মফিজুল ইসলাম।
অভিযোগ ও অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই মৃত: মুক্তিযোদ্ধার একমাত্র ছেলে আঃ জব্বার। জব্বার আরো জানায়, আমার বাবার বাড়ি উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামে ছিল। ‘৭১ এর যুদ্ধের সময় আমার বাবা দেশ স্বাধীন করতে ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নেয়। ভারতের মুজিব ক্যাম্পে ট্রেনিং নিতে যাদের সংগে আমার বাবা ছিল, তাদের মধ্যে ৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা এখনো বেঁচে আছেন। সেই বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্বাক্ষি দিলেও আমার বাবার নামে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা চালু করেনি সমাজ সেবা অফিস।
সঠিক তদন্তের মাধ্যমে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার ভাতা বাতিল করে ভারতীয় তালিকায় থাকা তার বাবার নামে ভাতা চালু করার আকুতি জানিয়েছেন জব্বার।
ওদিকে, জব্বারের অভিযোগ সত্যাসত্য যাচাইয়ে সরেজমিনে উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার ৪ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা হয়। তারা এ প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, হাতিয়া অনন্তপুরের মফিজুল ইসলামসহ আমরা ভারতের মুজিব ক্যাম্পে একসাথে প্রশিক্ষন নিয়েছি। প্রশিক্ষন শেষে সে অন্য গ্রুপের সাথে কোথায় যে যুদ্ধে যায় ? তা আমরা জানি না। তাদের একজনের সাথে মফিজুল ইসলামের শেষ দেখা হয়েছিল নিলফামারিতে দেশ স্বাধিন হওয়ার পরপরই। সে আর কখনোই বাড়ি ফিরে আসেনি। একসাথে ট্রেনিং নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সকলেরই ধারনা মফিজুল যুদ্ধের পরই কোন না কোন ভাবেই মারা যায়। তাই সে আর পরিবারের কাছে ফিরে আসেনি।
সাক্ষাতকার দেয়া বীর মুক্তিযোদ্ধারা হলেন, মোঃ আব্দুল বাতেন সরকার, (ভারতীয় তালিকা নং ৩৯৬৮১), নুর মোহাম্মদ, (ভারতীয় তালিকা নং ৩৯৬৮২), মোঃ রবিউল ইসলাম, (পরিচিতি নং ০১৪৯০০০১৭৯৯), শ্রী সুবল চন্দ্র রায়, ভারতীয় তালিকা নং ৩৯৪৭৯। সকলেরই বাড়ি উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নে। সাক্ষাতকার দেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, সঠিক তদন্ত হলেই আসল মুক্তিযোদ্ধার বিষয়টি বেড়িয়ে আসবে।
অনুসন্ধানে, উলিপুর উপজেলা সমাজসেবা অফিসার লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, জোবেদা বেগমের ঠিকানা উত্তর দলদলিয়া। অথচ জোবেদা বেগমের আবেদনে বর্তমান ঠিকানা দেয়া ছিল তবকপুর ইউনয়নে। জোবেদার দেয়া চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট বদল করে এবং আবেদন পত্রে কাটাছেড়া করে, ঠিকানা বদলিয়ে জোবেদাকে ভূয়া প্রমান করানো হয়েছে সমাজ সেবার তদন্ত রিপোর্টে। সঠিক তদন্ত হলে থলের বিড়াল বেড়িয়ে পড়বে।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোঃ লুৎফর রহমান এ প্রতিনিধিকে জানান, আমি দাখিলকৃত কাগজপত্র ও ভাতাভোগী মফিজুল ইসলামের স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ্য প্রমানের ভিত্তিতে তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছি। আসলে জোবেদার পক্ষে কোন ভাল লোক সাহায্য করেনি কিংবা স্বাক্ষ্য দেয়নি।
আবারও, পূণরায় তদন্ত হলে আর তদন্তের দায়িত্ব আমার দপ্তরে আসলে আমি বিষয়টি ভালভাবেই তদন্ত করে দেখবো বলে জানিয়েছেন তিনি।
অতি সম্প্রতি অভিযোগের অনুলিপি প্রাপ্তির কথা স্বীকার করে উপজেলা নির্বাহী অফিসার নয়ন কুমার সাহা জানান, আমি বিষয়টি নিয়ে তথ্য অনুসন্ধান করছি। উপরের নির্দেশনা পেলেই নতুনভাবে যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বের করা হবে।